তাত্ত্বিক প্রবন্ধ ::::: এপ্রিল – ’১২

বাংলা সালের উৎপত্তি

ড. আশরাফ সিদ্দিকী

 

সন শব্দটি আরবী ভাষা থেকে আগত। অর্থ – বর্ষ বা বর্ষপঞ্জি, বছরের দিন-ক্ষণের বিবরণ। মোগল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৯) নির্দেশে এবং পণ্ডিত আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর গবেষণার ফলে বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছে ৯৯২ হিজরী সন মুতাবিক ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দে।

হিজরী সনের উদ্ভব হয়েছে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের সময় তথা ৬২২ খৃষ্টাব্দ থেকে। এই সনের শুরু ২০ জুলাই – ৬২২ খৃষ্টাব্দ ধরা হয়েছে। অবশ্য হিজরতের তারিখ ছিলো রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার মুতাবিক ২০ সেপ্টেম্বর – ৬২২ খৃষ্টাব্দ। কিন্তু যেহেতু আরব দেশের নিয়ম অনুযায়ী বছরের প্রথম দিন ১ মুহাররম থেকে বছর শুরু হয়, তাই সেই বছরের শুরু থেকে হিসাব গণনা করা হয়েছে।

হিজরী সন ছিল চান্দ্র মাসের সাথে সম্পৃক্ত। আর চান্দ্র মাসের তারিখে চন্দ্রের উদয়-অস্ত হিসেবে সৌর মাসের তুলনায় বছরে ১১ দিনের ব্যবধান হয়। কারণ, চান্দ্র বছর হয় ৩৫৪ দিনে আর সৌর বছর হয় ৩৬৫ দিনে। প্রতিবছরের এ ১১ দিনের তফাৎ কয়েক বছরে অনেক ব্যবধান হয়ে ক্রমশ বাড়তে থাকলে সম্রাট আকবর কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ে সমস্যা আঁচ করেন। কেননা, ফসলাদি উৎপন্ন হয় মৌসুমভিত্তিক – যা সৌর মাসের সাথে সম্পৃক্ত। তাই সম্রাট আকবরের নির্দেশে আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজী তৎকালীন ৯৬৩ হিজরী সনকে ৯৬৩ বাংলা সনরূপে স্থির করে চান্দ্র বর্ষকে সৌর বর্ষে রূপান্তর করতঃ সৌর বছর ভিত্তিক হিজরী সন তথা প্রচলিত বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি সেই বছরের ১লা বৈশাখ থেকে এ সনের গণনা শুরু করেন। কারণ, ৯৬৩ হিজরী মুতাবিক ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের (১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ) বাংলা তারিখ হয় ১ বৈশাখ। এদিক দিয়ে এ সন যেমন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের স্মারক, তেমনি এর ১ম তারিখ সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের স্মৃতিবহ।

যেহেতু বাংলা সনের ভিত্তি হিজরী সন এবং ৯৬৩ হিজরী থেকে বাংলা সনকে সৌর সনরূপে রূপান্তর করা হয়েছে, আর সে সময় খৃষ্টাব্দ ছিল ১৫৫৬,  তাই হিজরী সনের সাথে ৫৯৩ যোগ দিলেই ইংরেজী সনের সাথে তা মিলে যায়। সম্রাট আকবর অবশ্য তার রাজত্বকালের ২৯তম বর্ষে ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দে দেশে এই সন চালু করেন।

সুতরাং স্মার্তব্য হলো – বাংলা সনের নবযাত্রা ৯৬৩ হিজরীতে – যাকে বাংলা ৯৬৩ সন ধরা হয়েছিল, যা ছিল ১১ এপ্রিল – ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ। আরো স্মার্তব্য হলো – প্রবর্তিত বাংলা সন ও প্রচলিত হিজরী সন সেই নবপর্যায়ের শুরুলগ্নে এক হলেও প্রতিবছর সৌর মাস ও চান্দ্রমাসের হেরফেরে হিজরী সন বেড়ে বর্তমানে ১৪৩৩ হিজরী হয়েছে, আর বাংলা সন হয়েছে ১৪১৯ সন (১৪ এপ্রিলের পর)। এর কারণ, সৌর ও চান্দ্র বছরের ১১দিনের কম-বেশ। প্রতিবছর চান্দ্র বছর (হিজরী সন) যেহেতু ১১দিন এগিয়ে যায়, সেই হিসেবে সৌর বছর (বাংলা সাল) তার থেকে ১১দিন পিছিয়ে যায়।

অবশ্য ইতোপূর্বে এদেশে তিন শ্রেণীর মুখ্য সন প্রচলিত ছিল –

১। চান্দ্র সন : চন্দ্রের বর্ষ পরিক্রমা হিসেবে সাড়ে ২৯ দিনে চান্দ্র মাস হিসাবে চান্দ্রবর্ষ হয় ৩৫৪ দিন ৯ ঘণ্টায়। অবশ্য চন্দ্রের প্রকাশ হিসেবে কোন মাস ৩০ দিনে এবং কোন মাস ২৯ দিনের হয়।

২। সৌর সন : সূর্যের বার্ষিক গতি অনুযায়ী সৌরবর্ষ হয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টায়। আর মাস হিসেবে চারমাস ৩০ দিনে এবং সাতমাস ৩১ দিনে হয়, আর এক মাস হয় ২৮ দিনে। তবে সমন্বয়ের জন্য প্রতি ৪র্থ বছরে তাতে ১দিন বাড়িয়ে ২৯ দিনের ধরা হয়।

৩। নক্ষত্র সন : রাশিচক্রের মধ্য দিয়ে সাতাশটি নক্ষত্র পরিক্রমায় সাড়ে ২৯ দিন হয়। আর সাড়ে ২৯কে তিথি হিসাবে ধরলে ৩০x১২=৩৬০ দিনে নক্ষত্র সন হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের সব উৎসব অনুষ্ঠিত হয় এ তিথি বা চান্দ্র দিনের হিসাবে।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে ১৯৬৮ সনে বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে প্রচলিত বাংলা সন এভাবে সংস্কার করা হয় : বৈশাখ থেকে ভাদ্র পাঁচমাস ৩১ দিনে (=৩১x৫=১৫৫ দিন) এবং আশ্বিন থেকে ফাল্গুন ছয়মাস ৩০ দিনে (=৩০x৬=১৮০); আর চৈত্র মাস সাধারণভাবে ৩০ দিনে, তবে অতিবর্ষে ১ দিন বাড়িয়ে ৩১ দিনে ধরা হবে (+৩০=৩৬৫ এবং অতিবর্ষ ৩৬৫+১=৩৬৬)। এটিই বর্তমানে প্রচলিত রয়েছে।

বলা বাহুল্য, ১৫৭৫ খৃষ্টাব্দে সম্রাট আকবর এদেশের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন। আর তিনি লক্ষ্য করেন – চান্দ্র সনের হিসাবে বছর ১০/১১ দিন এগিয়ে আসে বলে চাষীদের নির্দিষ্ট দিনে খাজনা দেয়ার এবং চৈত্রের বোরো ফসল, রবি ফসল প্রভৃতি ওঠার ক্ষেত্রে সৌর মাস নির্ভর বাংলা সনের হিসাব এদেশে সুবিধাজনক হবে। এ জন্য তিনি হিজরী সনের ওপর ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। এ জন্য এই আকবরী সনকে ‘ফসলী সন’ও বলা হতো। আর এদেশের ষড়ঋতুর সাথেও এ সন সামঞ্জস্যশীল। তাই এদেশের গ্রাম-গঞ্জে এ সনের ব্যাপক প্রচলন হয়েছে এবং এদেশের মানুষ একে আত্মস্থ করে নিয়েছেন।

 

Related posts

One Thought to “তাত্ত্বিক প্রবন্ধ ::::: এপ্রিল – ’১২

  1. Surya

    So much info in so few words. Tosltoy could learn a lot.

Leave a Comment